somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুপ্ত অক্ষমতা : শিশু ও আমরা -৩

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৪:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ASD তথা অটিজম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা বনাম বাস্তবতা


ভ্রান্ত ধারণা ১: ASD একটি আচরণগত/ আবেগঅনুভূতিগত/ মানসিক স্বাস্থ্যঘটিত ডিজঅর্ডার। এখানে শারীরিক কোন সমস্যা সম্পৃক্ত নয়।
বাস্তবতা: অটিজমের সঙ্গে বিকাশগত অক্ষমতা ও নিউরো-বায়োলজিকাল ডিজঅর্ডার জড়িত। জন্মের তিন বছরের মধ্যেই এটা প্রকাশ পায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি আজীবন এই অক্ষমতার সমস্যায় ভোগে।

ভ্রান্ত ধারণা ২: অটিস্টিকদের সবার সমস্যাই একরকম।
বাস্তবতা: ASD আক্রান্ত ব্যক্তিদের লক্ষণ ও উপসর্গের মাত্রা বিচিত্র। একজনের সঙ্গে আরেকজনের হুবহু মিল নেই। কেউ সবাক; বাকশক্তি থাকা সত্ত্বেও কেউ কথা বলেনা। কারও আচরণ অ্যাগ্রেসিভ, কেউ অতিরিক্ত গুটিয়ে-থাকা স্বভাবের। Spectrum Disorder কথাটি অটিজমের বিশাল আওতার বৈশিষ্ট্য বোঝানোর জন্যই ব্যবহৃত হয়।

ভ্রান্ত ধারণা ৩: পিতামাতার দুর্বল অভিভাবকত্ব সন্তানের অটিজমের জন্য দায়ী।
এই ধারণাটি অজ্ঞতাপ্রসূত এবং সম্পূর্ণ ভুল। অটিজমের সুনির্দিষ্ট কারণ এখন পর্যন্ত অজানা; বা সুপ্রমাণিত নয়। অনিরূপিত অটিজমের ক্ষেত্রে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ না নেয়া হলে অবস্থার উন্নতি পিছিয়ে যায়; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে জন্ম-পরবর্তী সময়কার weak parenting শিশুর অটিজমের জন্য দায়ী ছিল।

ভ্রান্ত ধারণা ৪: অটিজম নিরাময়যোগ্য, চিকিৎসা করালে অটিস্টিক ব্যক্তি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
এই ধারণার পিছনে মূলত: দায়ী হল নন-মেডিকেল সেলিব্রিটি ব্যক্তিত্বদের প্রচারণা (জেনি ম্যাকার্থি, অপরাহ্ উইনফ্রে প্রমুখ)।
কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং অতিনিবিড় ইনটারভেনশন ও থেরাপির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্যতার এই প্রচারণার সঙ্গে চিকিৎসক-গবেষকরা এখনও একমত হননি।

ভ্রান্ত ধারণা ৫: ASD আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী।
বাস্তবতা: অটিস্টিকদের কেউ কেউ হয়তো বিশেষ পরিস্থিতিতে খুব ভাল আইকিউ স্কোর করতে পারে অথবা বিশেষ কোন কাজে দক্ষতা দেখাতে পারে, কিন্তু এটা নিছকই ব্যতিক্রমী ঘটনা। সাধারণ অটিস্টিক জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য মিডিয়ায়, চলচ্চিত্রে বা সাহিত্যে সমাদৃত হবার মতো আকর্ষণীয় কিছু নয়। বিশেষ কোন দক্ষতার অধিকারী অটিস্টিককে নিয়ে লিখিত উপন্যাস পড়ে, কিংবা তাকে নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারি বা চলচ্চিত্র দেখে অনেকে ধারণা করে নেন ASD আক্রান্ত সবারই বিশেষ কোন প্রতিভা থাকে (যেমন গণিতে ভাল হওয়া)। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র রেইনম্যানে ডাস্টিন হফম্যানের চরিত্র, অথবা আইনস্টাইনের অটিজম থাকার প্রসঙ্গ অনেকেই জানেন এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে ভালবাসেন। বাস্তবতা হলো আমেরিকায় শিশুদের প্রতি ১৫০ জন একজন এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১৬০ জনে একজন শিশু অটিজম আক্রান্ত। যাদের অধিকাংশই ম্যাথ-জিনিয়াস হওয়া দূরে থাক, খুব সাধারণ দৈনন্দিন কাজকর্মেও অন্যের উপর নির্ভরশীল।

ভ্রান্ত ধারণা ৬: ASD আক্রান্ত শিশুদের সবারই কোনকিছু শিখতে সমস্যা হয়।
বাস্তবতা: ASD আক্রান্তদের মধ্যে কারো কারো মারাত্মক learning problem থাকে। কিন্তু কেউ কেউ, বিশেষত অ্যাসপারগার সিনড্রোম আক্রান্তদের অনেকেই, গণিতের মতো বিষয়ে মূলধারার শিশুদের মতোই দক্ষতা অর্জন করতে পারে। (স্মর্তব্য: অটিস্টিকদের ২০-৩০% অ্যাসপারগার সিন্ড্রোমে ভোগে)।

ভ্রান্ত ধারণা ৭: শিশুবয়সে নেয়া টিকা ASD-এর জন্য দায়ী।
বাস্তবতা: '৯০এর দশকে এই ধারণাটি খুব প্রচার পেয়েছিল। টিকার সংরক্ষণে ব্যবহৃত উপাদানে থাকা মার্কারি বা পারদ এজন্য দায়ী-- এমন কিছু গবেষণাও করা হয়। তবে ২০০১-২০০২-এ ব্যাপক আকারে হওয়া গবেষণার ফলাফল এই অনুমানকে নস্যাত করে দেয়।

ভ্রান্ত ধারণা ৮: ASD আক্রান্তদের জন্য বিশেষ ধরণের খাবার প্রয়োজন।
বাস্তবতা: এটা সত্য যে অটিস্টিকদের অনেকেই দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার, গ্লুটেন সমৃদ্ধ খাবার ইত্যাদির প্রতি অ্যালার্জিক। চিনি ও ফুড এসিডের পরিমাণ বেশী, এমন খাবারও কারও আচরণে প্রভাব ফেলতে পারে (উত্তেজনাবৃদ্ধি, খিটখিটে মেজাজ)। তবে এসব উদাহরণ কোন সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো নয়।

ভ্রান্ত ধারণা ৯: এটা একটা সাময়িক সমস্যা; বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেরে যাবে। কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার দরকার নেই।
বাস্তবতা: অটিস্টিক শিশু কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠবে না। তারপরও, মৃদু মাত্রার অটিজম, যেমন অ্যাসপারগার সিনড্রোমের ক্ষেত্রে যথাযথ সহযোগিতা, সমর্থন ও শিক্ষা পেলে পরিণত বয়সে আত্মনির্ভরতা অর্জন করা সম্ভব। বাকীদের বেলায়, উচ্চমাত্রার অটিজমের ক্ষেত্রে পরিণত বয়সেও অন্যের সাহায্য ছাড়া কখনোই স্বনির্ভর দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্ভব নয়।

ভ্রান্ত ধারণা ১০: একই পরিবারে অটিজম থাকার ঘটনা একবারের বেশী ঘটেনা।
বাস্তবতা: যদিও অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোন কারণ এখনও সুপ্রমাণিত নয়; তারপরও জেনেটিক ডিজঅর্ডার অটিজমের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে ধারণা করা হয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে একই পরিবারে ভাইবোনদের মধ্যে একাধিকজনের এবং যমজ সন্তানদের উভয়ের অটিস্টিক হবার প্রবণতা দেখা গেছে।

ভ্রান্ত ধারণা ১১: অটিস্টিকদের সংখ্যা বাড়ছে না, আগেও একই হারে ছিল; এখন ডায়াগনোসিসের সুযোগ বেশী তাই সংখ্যা বেশী মনে হচ্ছে।
বাস্তবতা: পৃথিবীতে মাত্র চারটি দেশে অটিস্টিকদের সংখ্যার হিসাব রাখার ব্যবস্থা আছে (ইউএসএ, ইউকে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়; তাও সর্বত্র অপেক্ষাকৃত মৃদু মাত্রার অ্যাসপারগার সিনড্রোম ও PDDNOS কে হিসেবের মধ্যে ধরা হয়না। এইসব দেশের হারকে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে অটিস্টিকদের অনুমিত সংখ্যা হিসাব করা হয়)। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব দেশের কোথাও কোথাও অটিস্টিকদের সংখ্যা ৫০০%-১০০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হার নি:সন্দেহে আতঙ্কজনক।

ভ্রান্ত ধারণা ১২: অটিজম থাকলে অন্য কোন ধরণের ডিজঅর্ডার থাকেনা।
বাস্তবতা: অটিস্টিকদের ক্ষেত্রে ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি, অন্ধত্ব, বধিরতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা কিংবা অন্য কোন শারীরিক সমস্যা থাকার ঘটনা অস্বাভাবিক তো নয়ই; বরং সাধারণ।


পর্ব-১
পর্ব-২
------------------------------------------------------------------
গত পর্বে পরিসংখ্যানের আগ্রহ প্রকাশকারী সহব্লগাররা এই পর্বের ৫ ও ১১ নম্বর পয়েন্টদুটো দেখে এবিষয়ে পরিসংখ্যানের অপ্রতুলতার কিছু ধারণা পেতে পারেন।

পরের পর্বে থাকবে : অটিস্টিক শিশু
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০০৯ সকাল ১১:১৯
৭৩টি মন্তব্য ৬১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×